রবিবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৬

স্কুলে প্রথম দিন

আমার স্কুল জীবন শুরু চতুর্থ শ্রেণী থেকে ।রেজাউল করিম স্যার অবশ্য তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হতে বলেছিলেন ।তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।এক প্রকার বলে কয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হই।বাড়ির পাশেই স্কুল।স্কুলটির তখনও কোন গৌরবোজ্জ্বল  অতীত হয়ে উঠেনি।তবে সোনালী ভবিষ্যৎ যে তার জন্য অপেক্ষা করছে সেটা আমারা সবাই অনুভব করতাম।স্কুলের নাম আশরাফাবাদ  উচ্চ বিদ্যালয় ।প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৮৪,প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য আশরাফাবাদই কামরাঙ্গীর চরবাসীদের মূল ভরসা ।

একদিন স্কুলে  যাই, সেখান থেকে চারটা নতুন বই আর দুইটা পুরাতন বই দেয়া হয় ।নতুন সব কিছুই ভালো তবে নতুন বইয়ের গন্ধ ও অনুভূতির সাথে কোন নব্যতার তুলনা হয় না।নতুন বইয়ের মধ্যে থাকা বিভিন্ন ছবি দেখে দেখে কল্পনায় ছবিগুলোর ভাষা দিতে থাকি।আমার কল্পনার কথাগুলো আমি আমার ছোট ভাইদের বলি ।আমার কল্পনা যে ওদের বিশ্বাস হয়েছে সেটা আমি ওদের চোখের দ্যুতি দেখে বুঝতে পারি।আমার কল্পনা ,ওদের বিশ্বাস একে অন্যকে জড়িয়ে বেঁচে থাকে।অনেক সময় বই দিয়ে আমরা ছবি গননা খেলা খেলতাম।ছবি দেখলেই তার ভাষা দিতে চাওয়া মূল কারণ হয়তো আমার শিশুকাল থেকে কমিক্স পড়ার বাতিক।নিজে পড়তে পারতাম না।বোনের কাছ থেকে কান্নাকাটি করে কমিক্স শুনতাম।আমার বোন ভাল বাংলা পড়তে পারতেন।বাংলা পরতেন না যেন আবৃত্তি করতেন।চতুর্থ শ্রেনীতে ভর্তি হলে হবে কী আমি তখনও বাংলা পড়তে জানি না।একারণেই স্যার আমাকে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হতে বলেছিলেন।লজ্জায় তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হই নাই।সেই চতুর্থ শ্রেণীই আমার জীবনের প্রথম শ্রেণী।

নামঃকামাল,রোলঃ৬৯,শাখাঃখ, ক্লাসে বসে আছি।বেঞ্চটা এতোটা নড়বড়ে যে,ঢেঁকির মতো এক প্রান্তে চাপ দিলে অন্য প্রান্ত জেগে উঠে। আমার পাশে যে বসেছে-সে আর আমি বেঞ্চের পায়ায় নীচে কিছু কাগজ দিয়ে দোলানি বন্ধ করি।মেজেটাও নোংরা-হাজার হাজার বরই বিচি,তেঁতুলের বিচি সেখানে পড়ে আছে।সবাই চণ্ডীমণ্ডপ পাকিয়য়েছে।আমি ছাড়া এখানে সবাই সবার পূর্বপরিচিত।সবাই স্কুল-ড্রেস পরে না আসলেও শার্ট,প্যান্ট পরে এসেছে। একমাত্র আমিই পাঞ্জাবি পায়জামা পরা।মাদরাসায় পড়ি তখনো স্কুল ড্রেস বানানো হয়নি।আমার কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে।এদেরকে আমার দূরের কেউ মনে হচ্ছে না।এরা যেন আমার কত আপনজন।অনেক আগে অনেক দূরে কোন এক অজানা মাঠে অচেনা বিকেলে ওদের সাথে আমি আনন্দে খেলা করেছিলাম।অথবা কোন এলোমেলো পথ হাত ধরাধরি করে হেটেছিলাম।তা না হলে এদের আমার এত পরিচিত মনে হবে কেন?
আমি চুপচাপ বসে আছি।প্রথমে কোন জায়গায় গেলে সবাই হয়তো ভদ্র হয়ে থাকার চেষ্টা করে।আমিও তাই করছি।শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ মাত্রই সবাই উঠে দাঁড়াল।আমিও দাঁড়ালাম,ব্যাপারটি আমার কাছে নতুন।মাদরাসায় শ্রেণীকক্ষে উস্তাদ ডুকলে কখনো ছাত্রদের দাঁড়াতে হয় না।স্যার এসে সবাইকে বসতে বললেন।সবাই বসে পড়লো। তিনি দাঁড়িয়েই রইলেন !

আমাদের শ্রেণীশিক্ষক এর নাম হুমায়ুন।তিনি নিজের পরিচয় দিলেন। জানতে চাইলেন,আমরা কেমন আছি?আমরা বললাম,ভালো,আপনি কেমন আছেন?
স্যারঃভালো,আজ তোমাদের নাম রোল নাম্বার সহ হাজিরা ডাকবো।এর পর থেকে শুধু রোল ধরে ডাকবো।তোমরা নিজেদের রোল নাম্বার মুখস্ত করে রেখো।প্রথমে আমি "ক"শাখার হাজিরা ডাকছি।
১/সাবিনা ইয়াসমিন
২/মৌসুমি
যে হাজির আছে সে তার রোল ডাকার সাথে সাথে দাঁড়িয়ে "উপস্থিত"কিংবা "ইয়েস স্যার" বলে জবাব দিচ্ছে।আমরা মাদরাসায় বসে থেকে লাব্বাইক বলে জবাব দেই।লাব্বাইক শব্দটা আমার কাছে ছিল জেগে উঠার প্রতিধ্বনি।হুজুর নাম ডাকার সাথে সাথে লাব্বাইক বলা ছিল আমার কাছে গর্বের বিষয়।এখানে লাব্বাইক এর পরিবর্তে উপস্থিত বলতে হবে।আমি উপস্থিত বলার জন্য মনে মেনে প্রস্তুতি নিচ্ছি।"ক" শাখা শেষ করে স্যার "খ"শাখা ধরলেন।এদিকে আমার বুক ধরফর শুরু।নতুন সব কিছুই মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়।

স্যার ঊনসত্তর ঊনসত্তর করে ডাকছেন, স্যার আমার নাম সহ রোল ধরে দুই বার ডেকে ফেলেছেন। বিশ্বাস করো স্যারের সাথে বেয়াদবির স্পর্ধা এই অধমের তখনও ছিল না,এখনও নাই।শুধু ভয়ে অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম।স্যারের ডাক শুনতে পারছিলাম ঠিকই ।কিন্তু উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না।আমার পা দুটো যেন সম্পূর্ণ অবশ হয়ে গেছে।হয়তো আল্লাহর ইচ্ছায় হঠাৎ আমি দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে লাব্বাইক বলে ফেললাম।শ্রেণীকক্ষে হাসাহাসি শুরু হয়ে গেল।ওদের কাছে হয়তো লাব্বাইক নতুন তাই ওদের মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে।স্যার বললেন ,আগে মাদরাসায় পড়েছে তো তাই।হাসার কোন কারণ নাই।পরবর্তিতে "উপস্থিত"বলেই জবাব দিবে কেমন।কথাটা আমার কাছে ক্ষত-ঘায়ে মলম এর মত কাজ করল।আমার হতাশা দূর হয়ে গেল। কি জানি কেন এমন বোকামো করেছিলাম।কত বোকাই না ছিলাম আমি-এতো সহজ শব্দ "উপস্থিত" তাও বলতে পরি নাই।কী জানি,সবাই কী ভাবছে? মনে মনে শুধু একটাই চিন্তা আমাদের বাসার "নাবিলা" মেয়েটা তো আমাদের শ্রেণীতেই পড়ে।সে না আবার বাসায় গিয়ে এই ঘটনা বলে দেয়।

শনিবার, ১৪ মে, ২০১৬

বাকরখানি

খাবারে আমাদের সুনাম বিশ্বময়।  আমরা মাছে- ভাতে বাঙ্গালী।  এখন হয়তো কোন কোন সমালোচক বলে,আমরা ফাস্ট ফুড চাইনিজে ঢাকাবাসী।তোমরাই বলো ঢাকাইয়ারাই কি শুধু    চাইনিজ খায়,অন্য কেউখায় না বুঝি । আলবাত খায়। তবে কেন এই অপবাদ আমাদেরই  দেয়া হবে। যদিও ইদানিং ফাস্ট ফুড  চাইনিজ আমরা  একটু  বেশিই খাই। তাতে কি?-সমালোচকদের কাজেই তো শুধু সমালোচনা করা।আমরা মোগলাই কাচ্চি বাকরখানিও তো খাই।কই সেগুলোর কথা তো সমালোচকেরা বলে না।
অনেক  খাবারের সাথে আমাদের আবেগ ,সৃতি ,ভালোবাসা জড়িয়ে থাকে।লুকিয়ে থাকে অনেক অজানা ইতিহাস।এমনি এক শৈশবের সৃতি জড়ানো আবেগ মাখানো খাবারের নাম-বাকরখানি।প্রেম-বিরহের সৃতি স্বাক্ষর সরূপ যেই বাকরখানির নামকরণ তার সাথে জড়িয়ে আছে আমাদেরও কিছু শৈশবের সুখ,দুঃখ হাঁসি-কান্নার ইতিহাস।শিয়ালখালির মাঠে ফেড়িওয়ালা থেকে কিনে খাওয়া বাকরখানির স্বাদ আজও আমার মুখে লেগে আছে।শৈশবে শিশুদের ভালো খাবারে থাকে অরুচি,আর অখাদ্য কুখাদ্যে থাকে সুরুচি।তবে বকরখানি কিন্তু মোটেও অখাদ্য কুখাদ্য নয়।মচমচে খাস্তা তন্দুরে ভাজা একটি রুটি;মাঝে তিনটি দাগ কেটে পেট ফেড়ে দেয়া হয়েছে।খেলার মাঠে তা খাওয়ার পিছনে বিশেষ একটি কারণও ছিল। সেই বাকরখানি ছিল সাধারণ বাকরখানির থেকে ভিন্ন ও সুস্বাদু। শিয়ালখালির বাকরখানি আর এখনকার বাকরখানির মাঝে অনেক পার্থক্য। শৈশবের সেই স্বাদ এখন আর কোথায়ও খুজে পাই না। সেই স্বাদ নেই,সেই আবেগও নেই। এখনকার বাকরখানি তো আগের থেকে অনেক আধুনিক হয়েছে-ফেড়িওয়ালার টিনের ডিব্বা ছেড়ে সুপার শোপের কাচের সুকেসে উঠেছে।স্বাদটাই শুধু হারিয়ে গেছে। সেই স্বাদ আমি আজও খুঁজে ফিরি;যেটা থাকতো একটা টিনের চারকোনা ডিব্বার ভিতর,যাতে  কোন আলোর ঝলকানি ছিল না,ছিল মমতার পরশ।ডিব্বাটির তিন পাশে টিন এক পাশে সচ্ছ কাঁচ,সেটা দিয়ে ভিতরের সাজানো সারিসারি বাকরখানি দেখা যেত।সেই সচ্ছ কাঁচের ফাঁকের বাকরখানি দেখে কতো ছেলে স্কুলে যাওয়ার দোহাই দিয়ে মায়ের থেকে টাকা নিয়ে বাকরখানি খেতো তার হিসাব নাই।
আমাদের কেউ যখন ফেড়িওয়ালা থেকে কোন বাকরখানি কিনতো,তখন আমাদের তিন চারটা মাথা এক সাথে সেই কাঁচের ফাঁকে হুমড়ি খেয়ে পরতো।চোখগুলো অনুসন্ধান চালাতো;কোনটা সবচেয়ে বড়, কোনটা খাস্তা বেশি।কোনটায় লাভ বেশি। কখনো এমন একটা দিতে বলতাম যেটা ফেড়িওয়ালার পক্ষে বের করে দেয়া অসম্ভব। তখন বাধ্য হয়ে অন্য একটা পছন্দ করতে হতো।পছন্দনীয়টি যখন ডিব্বা থেকে বের করে তার উপর রসগোল্লার রস মাখিয়ে আমাদের হাতে দিত ,তখন মনে হতো যেন হাতে চাঁদ পেয়েছি।মচমচে ভাজা বাকরখানির উপর রসগোল্লার রসের প্রলেপ।সেটাও বিনামূল্যে! বাকরখানি কিনার সময় উপস্থিত সব বন্ধু সেটাতে সমান ভাগ পেতো। যে বাকরখানি কিনেছে আর যে কেনার সময় সেখানে উপস্থিত ছিল দু'জনেরই সমান অংশ।শৈশবে বাকরখানি খাওয়ার আসল মজাই ছিল সবে মিলে খাওয়ার মজা।এখন হয়তো তার থেকে  অনেক দামি ও মজার মজার অনেক কিছু খাই কিন্তু সবে মিলে খাই না।আমাদের মাঝে সাম্যতা নাই,তাই সেই স্বাদও নাই।

সেই আবেগ,সেই ভালোবাসা,সেই বাকরখানির স্বাদ হারিয়ে গেছে।যেমন হারিয়ে গেছে শৈশবের বন্ধুরা আর বাকরখানির সাথে বিনামূল্যে রসগোল্লার রস দেয়ার প্রচলন ও সেই বিক্রেতা।