এই যে পথ ,পাশেই একটা আমগাছ।
সেটাকে দেখে এখন মনে হচ্ছে,
মাথায় এক বোঝা অন্ধকার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।
চারদিকে অন্ধকার, ডালপালা ও তার আশেপাশে জমাটবাঁধা অন্ধকার।
বিজলি চমকায়,গাছের ডাল বিজলির আলোর প্রতিবন্ধক হয়ে
পরিবেশে এক অপরূপ চিত্রকর্ম তৈরি করে।
অন্ধকারে বাতাসে আম পাতার সঞ্চরণ পরিবেশকে আরও রহস্য়ময় ভয়ংকর করে তুলে।
ছয়টা না বাজতেই দোকানে দোকানে জ্বল জ্বল উজ্জ্বল বিজলি বাতি ।
অন্ধকারের ভয়ে তাদের এতো আয়োজন।
ঐ আলো না থাকলে দেখা যেতো কত অন্ধকার জমেছে এই শহরে।
আকাশে কালো মেঘ,বাতাসে কালো ধূয়া,পরিবেশে অচেনা অন্ধকার।
সবকিছুতেই যেন ভয়ংকর এক ঝড়ের পূর্বাভাস।
ধূসর-কালো মেঘ আকাশ বাতাস কালো করে পরিবেশে এক অচেনা অন্ধকার সৃষ্টি করছে।
বিজলি চমকালে আকাশ আলোকিত হয়।
কৃত্রিম আলোকে অকৃত্রিম আলো ভালোভাবে পরাজিত করে।
কৃত্রিম এই সমাজে আলোর কৃত্রিম নাগরেরা আলো নিয়ে রঙ্গ করতে ভালোবাসে ।
হোক না সেটা নকল আলো !
ওদের এই আলোর রঙ্গ দেখে ভুখা কাঙ্গালেরও রঙ্গ করার সাধ জাগে।
আজকের এই ভয়-সঞ্চারী প্রকৃতির নির্দয় আলো দেখে আলো-বিলাসীরাও পালিয়েছে যায় ।
আর যাদের জীবন কাটে অন্ধকারে তাদের রাত কাটাতে হয় এই নির্দয় আলোতে ।
নিজেদের যারা আলো-প্রেমিক বলে দাবী করে, ওরা আজ কোথায়?
ওরা আলো ভালোবাসে না ,ভালোবাসে তার রঙ্গ।
শিপন ভীত-চোখে আকাশ পানে চায়।
আসন্ন বিপদটা অনুমান করার চেষ্টা করে।
বৃষ্টি আর কী !শহরবাসীরা তো ঘূর্ণিঝড়ও ভয় পায় না।
শিপনও কিন্তু ভিতু না।
কী রোদ,কী বৃষ্টি,কী শীত,কোন কিছুই ওকে দাবাতে পারে না।
হাড় কাঁপানো শীতেও সে এক কাপড়ে উদম গায় দিব্যি ঘুরে বেড়ায়।
গ্রীষ্মের তপ্ত দুপরে সবাই যখন একটু ছায়া খোঁজায় ব্যস্ত
তখন ওকে শহরের তাতানো অলিগলিতে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরেতে দেখা যায়।
ডরায় শুধু ঐ নির্মম বৃষ্টিরে।
একবার প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় রহিম চাচা ওকে দেখে একটি মাত্র পাতলা কাপড় পড়ে আছে,
আর শীতের কাঁপুনি থেকে নিজেকে বাঁচাতে শরীরের সাথে যুদ্ধ করছে।
যে শীতে মানুষ গরম কাপড় পড়েও দাঁতে দাঁত বাড়ি খায়।
সেখানে ওর কাঁপুনিটা তেমন কিছুই না।
তাছাড়া ওর কাঁপুনিটা কি শীতের না ভারসাম্য রক্ষার বুঝা যায় না।
কিরে সুইটার পড়ছ না ক্যা?তোর শরীরে কি শীত নাই?
-''গরীবের আবার শীত!অভাবই তো গরীবের শরীর গরম কইরা রাহে''।
রহিম চায়ের দোকানদার ;রাস্তার পাশে টিন দিয়ে বানানো ছোট দোকান তার।
ফুটপাতে বসার জন্য দৈনিক বিশ টাকা করে পুলিশকে চাঁদা দেয়।
তার দোকানে কুলি দিন-মজুর রিক্সাওয়ালা ঠেলাওয়ালা চা বিস্কুট খায়।
আড্ডা দেয়।তারা সবাই নিম্নশ্রেণীর। শিপন আরো নিম্নশ্রেণীর।
ও রাস্তা থাকে,রাস্তার আবর্জনা কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করে।
এই পৃথিবীতে রাস্তার পাশের ঐ জায়গাটা ছাড়া ওর আর কিছুই নেই।
শিপন রহিমের দোকানে প্রতিদিন চা খায়।
ওর চা খাওয়া দেখে অনেকে হয়তো অবাক হয়।
হওয়ারই তো কথা।
হত দরিদ্র লোকের তো চা খেতে মানা।
তবুও সে চা খায়।চা তার নেশা।
ও হত দরিদ্র ফুটপাথবাসী ,ওর দু'চোখ উদয়াস্ত এক মুঠো অন্ন খোঁজায় ব্যস্ত।
ওর থালায় কখনও তাজা খাবার উঠে না।
জীবন ওর কাছে এক যুদ্ধ;
এই যুদ্ধের বিজয়ীর পুরস্কার এক থালা ভাত।
এতো শীত তবুও সে সুইটার পরছে না,
ছেলেটার কষ্টের কথা ভেবে
একবার রহিম মিয়া তার ব্যবহৃত একটা সুইটার শিপনকে দেয়।
শিপন সেটা নেয় ঠিকই ,তবে কোনদিন ওকে তা পড়তে দেখা যায়নি।
আত্মসম্মানের ভয়ে নয়, আত্মসম্মান ওর নাই ।
ওর মতে আত্মসম্মান হল বড়লোকের ফ্যাশন।
গরিবের আত্মসম্মানবোধ থাকতে নেই।
পেটে ক্ষুধা রেখে মুখ বুজে থেকে কি লাভ?
সে তো ছোটলোকদের মধ্যেও বড় ছোটলোক।
তবে আয়েস করে চা খেয়ে
দুই বেলা ভদ্রলোক সাজে।
তাছাড়া ও ভদ্রলোক সহ্য করতে পারে না।
নিজেকে শক্ত রাখতেই ও কখনোই গরমকাপড় বা সুইটার পড়ে না।
সন্ধ্যা থেকেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো।
দশটা না বাজতেই প্রবল বর্ষণ শুরু।
আকাশটাই যেন ভেঙ্গে পড়ছে।
হঠাৎ হঠাৎ বিজলির ঝলক পরিবেশকে আরো ভয়ংকর করে তুলছে।
পথের পাশে দাঁড়ানো বাড়িগুলোর ব্যালকনি বৃষ্টি থেকে রক্ষায় ছাউনির কাজ করে।
যেখানে সর্বত্রই ভিজার ভয় সেখানে এমন এক জায়গা বাস্তুহারাদের কাছে জান্নাত সরূপ।
এমনি একটি বারান্দার নীচে বিছানা পেতেছে শিপন।
এমনিতে পাততে পারেনি,
দারোয়ানের ঝাড়ি বকুনি খেয়ে পেরেছে।
কাঁটা দিয়ে কাঁটা উঠানোর মত ধনীরা গরীব দিয়ে গরীব তাড়ায়।
লোকে ভাবে গরীব বুঝি গরীব মারে।
বারান্দার নীচটা বৃষ্টি থেকে রক্ষায় শেষ ভরসা।
বিছানা পেতে শুয়ে আছে, চোখে ঘুম নাই।
গরীবের চোখে তো ঘুমের অভাব থাকার কথা না।
গরীবের অনেক অভাব থাকলেও ঘুম আর ক্ষুধার কোন অভাব থাকে না।
ঘুম আসবেই বা কিভাবে?।
পেটের খিধায় নাড়ি ভুঁড়ি সব চিপরাচ্ছে ।
হায়রে খিধা!নাড়ি ভুঁড়ি না খাইয়া আমারে খাইয়া হালা।
আমি বাচ্চা যাই।
একটা রুটি আর দুই কাপ চা ছাড়া সারাদিনে আর কিছুই খায়নি।
দিনেও দফায় দফায় বৃষ্টি হয়েছে।
বৃষ্টির কারণে কাগজ পলিথিন কুড়াতে বেড় হতে পারেনি।
বৃষ্টির দিন কাগজ কুড়ানো যায় না।
পথ-ঘাট সব ভিজা থাকে ।কাগজও ভিজে যায়।
তাই বৃষ্টির দিনগুলোতে ওকে অনাহারেই কাটাতে হয়।
ভাগ্য ওকে গতকাল অতিরিক্ত সাত টাকা দিয়ে ছিল ।
খেয়ে পুরে বাঁচা সাত টাকা।
তাতেই এই চা- রুটি।কাল যদি বৃষ্টি হয় তবে কালও .........
পেটের ভিতরে চোঁ চোঁ করছিল,সেটা আরও বেড়ে গেলো।
বৃষ্টির উপর এমনিতেই মেজাজটা চড়ে ছিল,এখন আরও চড়ে গেলো।
মানবসৃষ্ট শোষিত প্রথার কারণে প্রকৃতির কল্যাণী বস্তুও যখন ওদের বিরুদ্ধে যায় তখন এই সমাজের শোষিতরা স্রষ্টাকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করায় ।
বৃষ্টির ছিটায় বিছানার এক পাশ ইতিমধ্যে ভিজে গেছে।
সেদিকে কোনই খেয়াল নেই শিপনের।
ও নড়েও না ,বিছানাও সরায় না।
বৃষ্টির কাছে পরাজিত হতে নারাজ।
জীবনের কাছে পরাজিত হয়ে ও এখন পরাজয়কে ভীষণ ভয় পায়।
জীবন থেকে মুক্তির আশায় কত বার যে ব্যস্ত রাস্তার মাঝে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে!
কিন্তু হায়,কোন গাড়িই তো ওকে চাপা দেয় না!
ড্রাইভারেরা কুকুর বিড়ালকে রেহাই না দিলেও, ছোটলোক আর মেয়ে-লোককে কখনই পিষে মারে না।
পাশে একটা নাড়াচাড়া টের পেয়ে শিপন ওর ছেড়া-ফাড়া দুর্গন্ধময় কাঁথা থেকে মাথা বের করে দেখল,বুলু ওর পাশে এসে শুয়েছে.।
ও এখানে আসার আগে বুলু কুকুরটা অবশ্য ওর এই ডেরাতেই থাকতো।
আজ বৃষ্টি তাই ওখানে মাথা গোঁজবার ঠাঁই নাই।
একারণেই ছাদের নীচের এই দিকটায় এসেছে।
দু'জনের একই অভাব, একই সংকট ।
খাদ্য বাসস্থানের অভাব, খাদ্য বাসস্থানের সংকট।
খাদ্য বাসস্থানের সংকটের মিলই হয়তো ওদের হৃদয়ের একাত্মতার মূল কারণ।
ওদের দুজনকেই জীবনে বহুবার ওদের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ হতে হয়েছে।
ওদের উচ্ছেদের খবর এই সমাজের ভদ্রলোকেরা রাখে না।
রাখবেই বা কেন?
ওরা তো এই সমাজের জঞ্জাল,আবর্জনা।
ওদের না তাড়ালে কি আর শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়!
শহর সৌন্দর্যের কথা উঠলেই সিটি কর্পোরেশন নগরের কুকুর বিড়াল আর ভ্রাম্যমাণ লোকদের উচ্ছেদে কমর বেঁধে নেমে পরে।
যেন এই ভাসমান লোকেরাই শহর অসুন্দরের মূল কারণ।
যদিও এই দেশে কেবল ভ্রাম্যমাণ লোকেরাই নিয়মিত ট্যাক্স দিয়ে শহরে থাকে।
যদিও সেটা সরকারি খাতায় জমা পড়ে না।
খিধের জ্বালায় ওদের পেটে যে চোঁ চোঁ ধ্বনি হয়
তা যদি ঐ দেহ ভেদ করে বেড়িয়ে আসতে পারতো
তবে এই শহরের আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করত,
ঘূর্ণিঝড় হত,ভূমিকম্পের সৃষ্টি হত।
ঐ কম্পনে ঐ ঝড়ে মজুতদারেরা রক্তচোষারা উড়ে যেত,ভেসে যেত।
মহাশক্তিশালী ঐ ধ্বনি কি আর এই শহরের ছদ্মবেশী দেশপ্রেমিকের হেডফোন ওয়ালা কানে পৌঁছাবার ক্ষমতা রাখে?
ওদের কানও যে প্রোটকলে ঘেরা!
ওরা তো সারা জীবনই ধিন্-তানা ধিন্-তানা ধ্বনি শুনতে পায়।
গরিবের পেটের খবর শুনার জন্য ওদের কি আর একটা কানও খোলা আছে?
শিপন আর বুলুর এই অঙ্গাঙ্গীভাব দেখে কে বলবে,
ওর কারণে বুলুকে তার ডেরা থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে।
বুলু কি ঐ উচ্ছেদের কথা মনে রেখেছে?
ওদের দেখে তো তা বোধ হয় না।
কারণ এর আগেও ওকে অনেকবার ওর বাসস্থান ছাড়তে হয়েছে
কিন্তু উচ্ছেদের পর উচ্ছেদকারীরা কখনই ওর খবর নেয়নি।
শিপন নিয়েছে।
চায়ের সাথে যদি কখনও রুটি খায় তবে রুটির কিছুটা হলেও বুলুকে দেয়।
বুলু লেজ নেড়ে নেড়ে রুটি খায় আর অদ্ভুত এক ভঙ্গিমায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
শিপন নিজে নিঃস্ব অনাহারী তবুও বুলুকে রুটি দেয় হৃদয়ের টানে।
বুলু আর শিপন পাশাপাশি জড় হয়ে শুয়ে আছে।
শিপন তার ছেড়া কাঁথার একটা অংশ দিয়ে বুলুকে জড়িয়ে দেয়।
বুলুও আরামে কুঁ কুঁ ডেকে উঠে।
শিপন রেগে গিয়ে-
-হালার বৃষ্টি তরেও ছাড়ে নাই।
সেটাকে দেখে এখন মনে হচ্ছে,
মাথায় এক বোঝা অন্ধকার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।
চারদিকে অন্ধকার, ডালপালা ও তার আশেপাশে জমাটবাঁধা অন্ধকার।
বিজলি চমকায়,গাছের ডাল বিজলির আলোর প্রতিবন্ধক হয়ে
পরিবেশে এক অপরূপ চিত্রকর্ম তৈরি করে।
অন্ধকারে বাতাসে আম পাতার সঞ্চরণ পরিবেশকে আরও রহস্য়ময় ভয়ংকর করে তুলে।
ছয়টা না বাজতেই দোকানে দোকানে জ্বল জ্বল উজ্জ্বল বিজলি বাতি ।
অন্ধকারের ভয়ে তাদের এতো আয়োজন।
ঐ আলো না থাকলে দেখা যেতো কত অন্ধকার জমেছে এই শহরে।
আকাশে কালো মেঘ,বাতাসে কালো ধূয়া,পরিবেশে অচেনা অন্ধকার।
সবকিছুতেই যেন ভয়ংকর এক ঝড়ের পূর্বাভাস।
ধূসর-কালো মেঘ আকাশ বাতাস কালো করে পরিবেশে এক অচেনা অন্ধকার সৃষ্টি করছে।
বিজলি চমকালে আকাশ আলোকিত হয়।
কৃত্রিম আলোকে অকৃত্রিম আলো ভালোভাবে পরাজিত করে।
কৃত্রিম এই সমাজে আলোর কৃত্রিম নাগরেরা আলো নিয়ে রঙ্গ করতে ভালোবাসে ।
হোক না সেটা নকল আলো !
ওদের এই আলোর রঙ্গ দেখে ভুখা কাঙ্গালেরও রঙ্গ করার সাধ জাগে।
আজকের এই ভয়-সঞ্চারী প্রকৃতির নির্দয় আলো দেখে আলো-বিলাসীরাও পালিয়েছে যায় ।
আর যাদের জীবন কাটে অন্ধকারে তাদের রাত কাটাতে হয় এই নির্দয় আলোতে ।
নিজেদের যারা আলো-প্রেমিক বলে দাবী করে, ওরা আজ কোথায়?
ওরা আলো ভালোবাসে না ,ভালোবাসে তার রঙ্গ।
শিপন ভীত-চোখে আকাশ পানে চায়।
আসন্ন বিপদটা অনুমান করার চেষ্টা করে।
বৃষ্টি আর কী !শহরবাসীরা তো ঘূর্ণিঝড়ও ভয় পায় না।
শিপনও কিন্তু ভিতু না।
কী রোদ,কী বৃষ্টি,কী শীত,কোন কিছুই ওকে দাবাতে পারে না।
হাড় কাঁপানো শীতেও সে এক কাপড়ে উদম গায় দিব্যি ঘুরে বেড়ায়।
গ্রীষ্মের তপ্ত দুপরে সবাই যখন একটু ছায়া খোঁজায় ব্যস্ত
তখন ওকে শহরের তাতানো অলিগলিতে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরেতে দেখা যায়।
ডরায় শুধু ঐ নির্মম বৃষ্টিরে।
একবার প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় রহিম চাচা ওকে দেখে একটি মাত্র পাতলা কাপড় পড়ে আছে,
আর শীতের কাঁপুনি থেকে নিজেকে বাঁচাতে শরীরের সাথে যুদ্ধ করছে।
যে শীতে মানুষ গরম কাপড় পড়েও দাঁতে দাঁত বাড়ি খায়।
সেখানে ওর কাঁপুনিটা তেমন কিছুই না।
তাছাড়া ওর কাঁপুনিটা কি শীতের না ভারসাম্য রক্ষার বুঝা যায় না।
কিরে সুইটার পড়ছ না ক্যা?তোর শরীরে কি শীত নাই?
-''গরীবের আবার শীত!অভাবই তো গরীবের শরীর গরম কইরা রাহে''।
রহিম চায়ের দোকানদার ;রাস্তার পাশে টিন দিয়ে বানানো ছোট দোকান তার।
ফুটপাতে বসার জন্য দৈনিক বিশ টাকা করে পুলিশকে চাঁদা দেয়।
তার দোকানে কুলি দিন-মজুর রিক্সাওয়ালা ঠেলাওয়ালা চা বিস্কুট খায়।
আড্ডা দেয়।তারা সবাই নিম্নশ্রেণীর। শিপন আরো নিম্নশ্রেণীর।
ও রাস্তা থাকে,রাস্তার আবর্জনা কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করে।
এই পৃথিবীতে রাস্তার পাশের ঐ জায়গাটা ছাড়া ওর আর কিছুই নেই।
শিপন রহিমের দোকানে প্রতিদিন চা খায়।
ওর চা খাওয়া দেখে অনেকে হয়তো অবাক হয়।
হওয়ারই তো কথা।
হত দরিদ্র লোকের তো চা খেতে মানা।
তবুও সে চা খায়।চা তার নেশা।
ও হত দরিদ্র ফুটপাথবাসী ,ওর দু'চোখ উদয়াস্ত এক মুঠো অন্ন খোঁজায় ব্যস্ত।
ওর থালায় কখনও তাজা খাবার উঠে না।
জীবন ওর কাছে এক যুদ্ধ;
এই যুদ্ধের বিজয়ীর পুরস্কার এক থালা ভাত।
এতো শীত তবুও সে সুইটার পরছে না,
ছেলেটার কষ্টের কথা ভেবে
একবার রহিম মিয়া তার ব্যবহৃত একটা সুইটার শিপনকে দেয়।
শিপন সেটা নেয় ঠিকই ,তবে কোনদিন ওকে তা পড়তে দেখা যায়নি।
আত্মসম্মানের ভয়ে নয়, আত্মসম্মান ওর নাই ।
ওর মতে আত্মসম্মান হল বড়লোকের ফ্যাশন।
গরিবের আত্মসম্মানবোধ থাকতে নেই।
পেটে ক্ষুধা রেখে মুখ বুজে থেকে কি লাভ?
সে তো ছোটলোকদের মধ্যেও বড় ছোটলোক।
তবে আয়েস করে চা খেয়ে
দুই বেলা ভদ্রলোক সাজে।
তাছাড়া ও ভদ্রলোক সহ্য করতে পারে না।
নিজেকে শক্ত রাখতেই ও কখনোই গরমকাপড় বা সুইটার পড়ে না।
সন্ধ্যা থেকেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো।
দশটা না বাজতেই প্রবল বর্ষণ শুরু।
আকাশটাই যেন ভেঙ্গে পড়ছে।
হঠাৎ হঠাৎ বিজলির ঝলক পরিবেশকে আরো ভয়ংকর করে তুলছে।
পথের পাশে দাঁড়ানো বাড়িগুলোর ব্যালকনি বৃষ্টি থেকে রক্ষায় ছাউনির কাজ করে।
যেখানে সর্বত্রই ভিজার ভয় সেখানে এমন এক জায়গা বাস্তুহারাদের কাছে জান্নাত সরূপ।
এমনি একটি বারান্দার নীচে বিছানা পেতেছে শিপন।
এমনিতে পাততে পারেনি,
দারোয়ানের ঝাড়ি বকুনি খেয়ে পেরেছে।
কাঁটা দিয়ে কাঁটা উঠানোর মত ধনীরা গরীব দিয়ে গরীব তাড়ায়।
লোকে ভাবে গরীব বুঝি গরীব মারে।
বারান্দার নীচটা বৃষ্টি থেকে রক্ষায় শেষ ভরসা।
বিছানা পেতে শুয়ে আছে, চোখে ঘুম নাই।
গরীবের চোখে তো ঘুমের অভাব থাকার কথা না।
গরীবের অনেক অভাব থাকলেও ঘুম আর ক্ষুধার কোন অভাব থাকে না।
ঘুম আসবেই বা কিভাবে?।
পেটের খিধায় নাড়ি ভুঁড়ি সব চিপরাচ্ছে ।
হায়রে খিধা!নাড়ি ভুঁড়ি না খাইয়া আমারে খাইয়া হালা।
আমি বাচ্চা যাই।
একটা রুটি আর দুই কাপ চা ছাড়া সারাদিনে আর কিছুই খায়নি।
দিনেও দফায় দফায় বৃষ্টি হয়েছে।
বৃষ্টির কারণে কাগজ পলিথিন কুড়াতে বেড় হতে পারেনি।
বৃষ্টির দিন কাগজ কুড়ানো যায় না।
পথ-ঘাট সব ভিজা থাকে ।কাগজও ভিজে যায়।
তাই বৃষ্টির দিনগুলোতে ওকে অনাহারেই কাটাতে হয়।
ভাগ্য ওকে গতকাল অতিরিক্ত সাত টাকা দিয়ে ছিল ।
খেয়ে পুরে বাঁচা সাত টাকা।
তাতেই এই চা- রুটি।কাল যদি বৃষ্টি হয় তবে কালও .........

পেটের ভিতরে চোঁ চোঁ করছিল,সেটা আরও বেড়ে গেলো।
বৃষ্টির উপর এমনিতেই মেজাজটা চড়ে ছিল,এখন আরও চড়ে গেলো।
মানবসৃষ্ট শোষিত প্রথার কারণে প্রকৃতির কল্যাণী বস্তুও যখন ওদের বিরুদ্ধে যায় তখন এই সমাজের শোষিতরা স্রষ্টাকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করায় ।
বৃষ্টির ছিটায় বিছানার এক পাশ ইতিমধ্যে ভিজে গেছে।
সেদিকে কোনই খেয়াল নেই শিপনের।
ও নড়েও না ,বিছানাও সরায় না।
বৃষ্টির কাছে পরাজিত হতে নারাজ।
জীবনের কাছে পরাজিত হয়ে ও এখন পরাজয়কে ভীষণ ভয় পায়।
জীবন থেকে মুক্তির আশায় কত বার যে ব্যস্ত রাস্তার মাঝে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে!
কিন্তু হায়,কোন গাড়িই তো ওকে চাপা দেয় না!
ড্রাইভারেরা কুকুর বিড়ালকে রেহাই না দিলেও, ছোটলোক আর মেয়ে-লোককে কখনই পিষে মারে না।
পাশে একটা নাড়াচাড়া টের পেয়ে শিপন ওর ছেড়া-ফাড়া দুর্গন্ধময় কাঁথা থেকে মাথা বের করে দেখল,বুলু ওর পাশে এসে শুয়েছে.।
ও এখানে আসার আগে বুলু কুকুরটা অবশ্য ওর এই ডেরাতেই থাকতো।
আজ বৃষ্টি তাই ওখানে মাথা গোঁজবার ঠাঁই নাই।
একারণেই ছাদের নীচের এই দিকটায় এসেছে।
দু'জনের একই অভাব, একই সংকট ।
খাদ্য বাসস্থানের অভাব, খাদ্য বাসস্থানের সংকট।
খাদ্য বাসস্থানের সংকটের মিলই হয়তো ওদের হৃদয়ের একাত্মতার মূল কারণ।
ওদের দুজনকেই জীবনে বহুবার ওদের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ হতে হয়েছে।
ওদের উচ্ছেদের খবর এই সমাজের ভদ্রলোকেরা রাখে না।
রাখবেই বা কেন?
ওরা তো এই সমাজের জঞ্জাল,আবর্জনা।
ওদের না তাড়ালে কি আর শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়!
শহর সৌন্দর্যের কথা উঠলেই সিটি কর্পোরেশন নগরের কুকুর বিড়াল আর ভ্রাম্যমাণ লোকদের উচ্ছেদে কমর বেঁধে নেমে পরে।
যেন এই ভাসমান লোকেরাই শহর অসুন্দরের মূল কারণ।
যদিও এই দেশে কেবল ভ্রাম্যমাণ লোকেরাই নিয়মিত ট্যাক্স দিয়ে শহরে থাকে।
যদিও সেটা সরকারি খাতায় জমা পড়ে না।
খিধের জ্বালায় ওদের পেটে যে চোঁ চোঁ ধ্বনি হয়
তা যদি ঐ দেহ ভেদ করে বেড়িয়ে আসতে পারতো
তবে এই শহরের আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করত,
ঘূর্ণিঝড় হত,ভূমিকম্পের সৃষ্টি হত।
ঐ কম্পনে ঐ ঝড়ে মজুতদারেরা রক্তচোষারা উড়ে যেত,ভেসে যেত।
মহাশক্তিশালী ঐ ধ্বনি কি আর এই শহরের ছদ্মবেশী দেশপ্রেমিকের হেডফোন ওয়ালা কানে পৌঁছাবার ক্ষমতা রাখে?
ওদের কানও যে প্রোটকলে ঘেরা!
ওরা তো সারা জীবনই ধিন্-তানা ধিন্-তানা ধ্বনি শুনতে পায়।
গরিবের পেটের খবর শুনার জন্য ওদের কি আর একটা কানও খোলা আছে?
শিপন আর বুলুর এই অঙ্গাঙ্গীভাব দেখে কে বলবে,
ওর কারণে বুলুকে তার ডেরা থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে।
বুলু কি ঐ উচ্ছেদের কথা মনে রেখেছে?
ওদের দেখে তো তা বোধ হয় না।
কারণ এর আগেও ওকে অনেকবার ওর বাসস্থান ছাড়তে হয়েছে
কিন্তু উচ্ছেদের পর উচ্ছেদকারীরা কখনই ওর খবর নেয়নি।
শিপন নিয়েছে।
চায়ের সাথে যদি কখনও রুটি খায় তবে রুটির কিছুটা হলেও বুলুকে দেয়।
বুলু লেজ নেড়ে নেড়ে রুটি খায় আর অদ্ভুত এক ভঙ্গিমায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
শিপন নিজে নিঃস্ব অনাহারী তবুও বুলুকে রুটি দেয় হৃদয়ের টানে।
বুলু আর শিপন পাশাপাশি জড় হয়ে শুয়ে আছে।
শিপন তার ছেড়া কাঁথার একটা অংশ দিয়ে বুলুকে জড়িয়ে দেয়।
বুলুও আরামে কুঁ কুঁ ডেকে উঠে।
শিপন রেগে গিয়ে-
-হালার বৃষ্টি তরেও ছাড়ে নাই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন